কবুতর ব্যবসা

স্বল্প পুঁজির কবুতর পালন পদ্ধতি ও লাভ ক্ষতির হিসাব জেনে নিন!

একটা সময় ছিল যখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতে কবুতর পালন করা হত। সেটা ছিল শখের একটি অনুষঙ্গ। কিন্তু আধুনিক জীবনের ব্যস্ততায় এসব কাজগুলোকে মানুষ বাড়তি ঝামেলা মনে করে। তাই এখন হাতে গোনা কয়েকটি ঘরেই কবুতরের ঝাঁক দেখা যায়। 

তবে কালের পরিক্রমায় অনেকেই কবুতর পালনকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। আপনি যদি কবুতর ব্যবসা নিয়ে ভেবে থাকেন তবে আর্টিকেলটি পড়ুন, কিছুটা হলেও কাজে আসবে। 

কবুতর ব্যবসা করতে হলে আপনাকে কি কি বিষয়ে জানতে হবে? 

যেকোনো কাজে নামার আগে সে সম্পর্কে পুঁথিগত বিদ্যা ও অভিজ্ঞদের কাছ থেকে জ্ঞান নেয়া দরকার। প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে কেউ ব্যবসা শুরু করলে প্রাথমিক ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। 

কবুতর ব্যবসার পরিকল্পনা করার আগে নিন্মক্ত বিষয়গুলো নিয়ে ভালোভাবে জেনে নিন। 

১। জাত চিনতে হবে এবং এগুলোর ব্যবহার জানতে হবে

পৃথিবীতে প্রায় ২০০ জাতের কবুতর আছে। বাংলাদেশে সবগুলো পাওয়া না গেলেও ৩০ প্রজাতির পাওয়া যায়। অনেকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে আমদানিও করে থাকেন। 

মানুষ সাধারত  দুইটি উদ্দেশ্যে কবুতর কিনে থাকে। যেমন- 

ক) খাদ্য হিসেবে স্কোয়াবঃ  

খাওয়ার জন্য বাচ্চা কবুতর বা স্কোয়াবের চাহিদা অনেক। মাংস উৎপাদনকারী কবুতরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- দেশি কবুতর, গিরিবাজ ইত্যাদি। 

খ) শখ ও বিনোদনের জন্যঃ 

কিছু কবুতর আছে যেগুলো সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত আবার কিছু কবুতর দিয়ে খেলাধুলা ও বিনোদনের জন্য মানুষ ক্রয় করে থাকে। 

লক্ষা কবুতর

সিরাজি, ময়ূরপঙ্খী, জ্যাকবিন, গিরিবাজ, লাহোরি, ফ্রিলব্যাক, ফ্যান টেইল, লোটান, মদীনা, মুখী, ট্রাম্পেটার, টেম্পলার, ট্রুবিট ইত্যাদি এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য। 

ফ্রিলব্যাক কবুতর

আপনি কোন জাতের কবুতর নিয়ে ব্যবসা করবেন, কোনটি আপনার জন্য সহজ হবে, কি উদ্দেশ্যে ব্যবসা করবেন তা ঠিক করে নিন। 

২। যত্ন সম্পর্কে জানতে হবেঃ 

কবুতরের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও যত্ন-আত্তি করার মানসিকতা না থাকলে এই ব্যবসায় আসা বৃথা। সুতরাং এর যত্ন সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান রাখার পাশাপাশি তার বাস্তবায়নও জরুরি। 

তাই এর বাসা কেমন হবে, খাবার কেমন হবে, চিকিৎসা কেমন ইত্যাদি সম্পর্কে গভীরভাবে জানা থাকা আবশ্যক। দেশি কবুতরের যত্ন ও বিদেশি কবুতরের যত্ন কিছুটা আলাদা। 

See also  কম খরচে সহজেই মুরগীর খামার তৈরির পদ্ধতি

ক) কবুতরের বাসস্থানঃ 

  • কবুতরের খোপ বা বাসা তৈরি করতে হবে উঁচু জায়গায় যেন বিড়াল, ইঁদুর ইত্যাদি থেকে এদের রক্ষা করা করা যায়। 
  • ঘরগুলোর লম্বা ঃ চওড়া ঃ উচ্চতা হবে যথাক্রমে ৩০ঃ৩০ঃ৩০ সেঃ মিঃ। দরজা বা ঘরে ঢোকার মুখের মাপ হবে ১০/১০ সেঃ মিঃ। এছাড়া এসব ঘরের সামনে অন্তত ৪ সেঃ মিঃ চওড়া তক্তা বা জায়গা থাকতে হবে উড়ে এসে বসার জন্য। 
  • প্রতিটি ঘর একটির সাথে অপরটি লাগানো থাকবে এবং প্রয়োজনে বহুতল করা যাবে। তবে ভেতরে দুইটি কবুতর ভালোভাবে থাকার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকা লাগবে। 
  • প্রতিটি ঘরে পর্যাপ্ত আলোবাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং সেই সাথে বৃষ্টির পানি বা শীতকালীন ঠাণ্ডা বাতাস যেন না ঢুকে তার ব্যবস্থাও থাকা লাগবে। 
  • নিয়মিত ঘরগুলো পরিস্কার রাখতে হবে। 
  • ঘরের কাছে পরিস্কার খাবার ও পানি রাখতে হবে। 
  • প্রতিদিন সকালে ঘরের ঢাকনা খুলে দিতে হবে ও সন্ধায় বন্ধ করতে হবে। 
  • কাছাকাছি জায়গায় কিছু খড়কুটো রাখতে হবে যেন তারা তাদের আরামআয়েশের জন্য নিয়ে ব্যবহার করতে পারে। 

খ) কবুতরের খাবারঃ 

আপনার কবুতরগুলোকে স্বাস্থ্যবান ও তাজা রাখতে হলে তাদের খাবার কি কি হবে এবং কি পরিমান হবে তা সম্পর্কে জানতে হবে। 

  • কবুতরের পুষ্টি চাহিদা অনেক বেশি, তাই তাদের খাবারের পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি কবুতরের খাবারে কমপক্ষে ১৫-১৬% প্রোটিন থাকতে হবে। এছাড়া প্রত্যেক কবুতর দৈনিক ৩৫-৫০ গ্রাম দানাদার খাদ্য গ্রহন করে থাকে। 
  • খাবার আলাদা আলাদা দেয়ার চেয়ে কয়েক ধরনের খাবার নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে দিলে তাদের পুষ্টি ঠিক থাকবে। ভাঙ্গা গম (২.৮) , ভুট্টা (২.২), ছোলা (১.০), সরিষা (১.০), সয়াবিন (০.৮), চাল ও তুষ (১.৮), লবন (০.৪) কেজি অনুপাতে মিশিয়ে দিতে পারেন। 
  • এছাড়া চুনাপাথর, ঝিনুক, গুঁড়ো করা হাড় ইত্যাদি খাবারও প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে। দানাদার খাবারের পাশাপাশি বিভিন্ন শাক-সব্জিও দেয়া যেতে পারে। 
  • ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। 

গ) বাজারের চাহিদা সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে

See also  ক্যাপসিকাম চাষ পদ্ধতি এবং উপকারিতা

বাজারে কোন ধরনের কবুতরের কি পরিমান চাহিদা আছে, দাম কেমন ইত্যাদি সম্পর্কে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে জেনে নিন।  

একেক জাতের কবুতরের দাম একেকরকম। আপনার খাবার খরচ, খোপ তৈরি খরচ, বাজারদর ইত্যাদির উপর নির্ভর করে প্রতিটি কবুতরের দাম নির্ধারণ করতে হবে। 

কবুতর পালনে লাভ কেমন?

স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো ব্যবসায় যাওয়ার আগে সবাই প্রথমে এর চাহিদা, লাভের কথাই চিন্তা করে। সুতরাং কবুতর ব্যবসার লাভ-ক্ষতির দিকগুলো সম্পর্কে একজন ব্যবসায়ী জানতে চাইবেন অবশ্যই। 

আসুন প্রথমে জেনে নেয়া যাক এর লাভজনক দিক কোনগুলো। তারপর এই ব্যবসার ঝুঁকি নিয়ে জানব। 

লাভজনক দিকগুলোঃ  

১। কবুতর পালন হল তুলনামুলকভাবে সল্প পুঁজিতে কম পরিশ্রমে অধিক লাভজনক ব্যবসা।

২। বাজারে বাচ্চা কবুতরের চাহিদা প্রচুর এবং এর দামও অনেক। কিন্তু সেই তুলনায় পালনের খরচ কম। 

৩। প্রাথমিক অবস্থায় সীমিত পুঁজি ও ছোট জায়গায় ব্যবসা শুরু করা সম্ভব। অর্থাৎ প্রথমে বাড়ির উঠোনে বা বাসার বারান্দা অথবা ছাদে সল্প পরিসরে আপনি শুরু করতে পারেন। এতে এই ব্যবসার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে সামনে এগোতে পারবেন। 

৪। কবুতর মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই ডিম দেয়া শুরু করে ও সঠিক যত্ন পেলে প্রতি মাসে দুইটি করে বাচ্চা ফোটাতে সক্ষম। ডিম ফোটাতে ১৮ থেকে ২০ দিন সময় নেয়। 

৫। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কবুতর পালনের ৩/৪ মাসের মধ্যেই লাভ উঠতে শুরু করে। 

৬। তুলনামুলকভাবে অন্যান্য পাখির তুলনায় কবুতরের রোগ-বালাই কম হয়। 

৭। কবুতরের মল বেশ ভাল মানের জৈব সার। তাই এটি আপনার নিজস্ব বাগানে ব্যবহার করতে পারেন বা নির্দিষ্ট পরিমান জমিয়ে নার্সারিতে বিক্রি করতে পারেন। 

৮। কবুতরের পালক দিয়ে বিভিন্ন শোপিস বানানো যায়। আপনি নিজেই এরকম কিছুর ব্যবসা করতে পারেন বা এগুলো বিক্রি করে এখান থেকেও কিছু আয় বের করে আনতে পারবেন। 

ঝুকির দিকগুলো 

সঠিক যত্ন নিতে পারলে সাধারনভাবে কবুতর পালনে ব্যবসার ঝুঁকি অনেকটা কম। কবুতরের রোগ ও এর প্রতিকার বা প্রতিশেধক সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত হলে ব্যবসায়ী তার ঝুঁকি এড়াতে পারবেন। 

See also  পদ্মার ইলিশ মাছের বৃত্তান্ত

কবুতরের যে সমস্ত রোগ হয়ে থাকে- 

১। বাচ্চা কবুতরের এডিনো ভাইরাসজনিত রোগ 

২। ডায়রিয়া  

৩।  ম্যালেরিয়া 

৪। গোয়িং লাইট

৫। পিজিওন পক্স

৬। নিউমোনিয়া বা ঠাণ্ডাজনিত রোগ 

৭। ক্যাঙ্কার 

৮। এগ বাইন্ডিং

৯। কক্সিডিওসিস 

১০।  রোপ 

বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস, পরজীবী ইত্যাদির কারনে কবুতরের এসমস্ত রোগ হয়ে থাকে। সঠিক যত্ন নিলে, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও খাবার দিলে, পিজিওন পক্সের টিকা দিলে ও নিয়মিত ভেটেরিনারিয়ান ডাক্তারের সাহায্য নিলে এসব সমস্যা এড়ানো সম্ভব। 

কোন জাতের কবুতর বেশি বাচ্চা দেয় 

গিরিবাজ কবুতর অন্যান্য জাতের কবুতরের চেয়ে বেশি ডিম দিয়ে থাকে। এগুলো তাদের বাচ্চা ছোট থাকা অবস্থায়ই নতুন ডিম দিতে পারে। 

এছাড়া কবুতর থেকে বেশি ডিম পেতে হলে পর্যাপ্ত প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। গম, ভুট্টা, সরিষা, ডিমের খোসা ইত্যাদি গুড়ো করে খাওয়ালে কবুতর বেশি ডিম দেয় এবং স্বাস্থ্যকর ডিম উৎপাদন হয়। এজন্য বিশেষজ্ঞ ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। 

কবুতর পালনে সফলতা / লাভ হিসাব

সবকিছু ঠিক থাকলে এক জোড়া কবুতর বছরে ১২ জোড়া কবুতরের জন্ম দেয়, যার বাজারদর ৩০,০০০ টাকা। কেউ যদি সল্প পুঁজি নিয়ে শুরু করতে চায় প্রথমে ১০,০০০ টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে শুরু করতে পারেন। তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই তার সেই টাকা উঠিয়ে আনা সম্ভব যদি সঠিক পন্থায় এগোতে পারেন। 

প্রথমে দেশি কবুতর দিয়ে শুরু করাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিদেশি কবুতর পালনের চেয়ে দেশি কবুতর পালনে সহজ এবং বাজারে চাহিদা সর্বাধিক। 

উপসংহারঃ 

অল্প পুঁজি নিয়ে কবুতর ব্যবসা শুরু করে মাসে লাখ টাকা আয়ের উদাহরন আমাদের দেশে অনেক আছে। পরিশ্রমই সফলতার চাবি। বেকার জীবনে অলসতা করে সময় না কাটিয়ে কিছু করাই হল বুদ্ধিমানের কাজ। 

আপনি যদি পাখিপ্রেমি হন তাহলে কবুতর পালন হতে পারে আপনার শখ পূরণের পাশাপাশি একটি বড় আয়ের উৎস। সঠিক পরিকল্পনা করে, আয়-ব্যয়ের হিসেব করে কাজে নেমে পড়ুন। আপনি সফল হবেনই। 

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *