সোনালি মুরগির পালন পদ্ধতি – লাভ, খরচ ও সমস্ত তথ্য
আমাদের দেশে সোনালী মুরগী পালনের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ সোনালি মুরগির রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। বর্তমান বাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি। তাই অনেকেই নতুন করে খামার করে সাবলম্বী হতে চায়, তাদের অনেকেই প্রথমে সোনালি মুরগি খামার করার কথা চিন্তা করে।
আবার অনেকেই আছেন ব্রয়লার বা লেয়ার মুরগির খামার করে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যার ফলে আবার অনেকেই নতুনভাবে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করে। তাদের জন্যই মূলত আজকের লেখাটি, কি করে একজন ব্যক্তি সঠিকভাবে সোনালি মুরগির খামার করতে পারে।
পরিচিতিঃ জয়পুরহাট জেলায় ১৯৯৬-২০০০ সাল পর্যন্ত গবেষণার করে সোনালী মুরগি জাত উদ্ভাবন করা হয়। এ মুরগি উদ্ভাবনকারীর নাম হল প্রাণীসম্পদ বিভাগের প্রধান ডা. মোঃ শাহ জামাল। তিনি আমেরিকান আরআইআর (RIR) প্রজাতির লাল মোরগ এবং মিশরীয় কালো ও সাদা ফাউমি মুরগির সাথে কোরাস করে এই নতুন জাতের সোনালী মুরগি উদ্ভাবন করেন।
সোনালী মুরগির শারীরিক বৈশিষ্টঃ সাধারণত ৬০ দিনের হিসাব করেই সোনালি মুরগি পালন করা হয়ে থাকে। সাধারণত সোনালি মুরগির গায়ের রং লাল,কাল,সাদা ,হলুদ ধরনের হয়ে থাকে। আকারে এরা মাঝারি আকৃতির হয়ে থাকে।ডিম ও মাংসের জন্য এই মুরগি পালন করা হয়ে থাকে । এরা বছরে ১৫০ টি থেকে ২০০ টির বেশি ডিম দিয়ে থাকে। ৬০ দিনে একটি মুরগির ওজন আসে প্রায় ৭০০-৭৫০ গ্রাম ।
প্রাপ্ত বয়স্ক একটি মোরগ – মুরগির ওজন সাধারণত ১.৫ কেজী থেকে ২.৫ কেজী হয়ে থাকে। হাইব্রিড সোনালী মুরগি গুলোও সাধারণত ৬০ দিনের হিসেব করে পালন করা হয়ে থাকে। আমরা জানি, যখন কোন পণ্য চাহিদা মত পাওয়া যায়না , তখন তার চাহিদা মেটানোর জন্য হাইব্রিড করা হয়। তেমনি ভাবেই সোনালি মুরগির চাহিদা মেটানর জন্য তৈরী করা হয় হাইব্রিড সোনালি মুরগি। বর্তমান সময়ে অনেক খামারিরাই হাইব্রিড সোনালি মুরগির চাষ ইচ্ছুক। কারন এদের খাবার খরচ একই পরিমাণ লাগে তবে সোনালি মুরগির চেয়ে হাইব্রিড মুরগি বেশি বাড়ে। মাংস উৎপাদনের জন্য এই মুরগির জাত তৈরী করা হয়েছে।
প্রাপ্ত বয়স্ক একটি মোরগ – মুরগির ওজন সাধারণত ২ কেজী থেকে ৩.৫ কেজী হয়ে থাকে। এদের গায়েরর রং সাধারণত লাল,কাল,সাদা ,হলুদ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে । ৬০ দিনে একটি মুরগির ওজন আসে প্রায় ৯০০ থেকে ৯৫০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।
সোনালী মুরগির বাচ্চা নির্বাচন:
সোনালি একটি স্বতন্ত্র মুরগির জাত হলেও বর্তমান বাজারে এর কিছু ভ্যারিয়েশন পাওয়া যায়। এগুলো হল সোনালি, সোনালি ক্লাসিক ও হাইব্রিড সোনালি নামে বাচ্চার বাজারজাত করন হয়ে থাকে। তবে সোনালি মুরগির বাচ্চার নির্বাচনে যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকতে হবে সেগুলো নিচে দেওয়া হল-১। একটি ভালো মানের বাচ্চার ওজন
৪। ভালো মানের বাচ্চার নাভীর চারপাশে শুষ্ক এবং ডাউন ফেদারবিহীন হবে না অর্থাৎ পশম থাকবে। ডাউনফেদার শুষ্ক, নরম এবং সমস্ত শরীরকে ঢেকে রাখবে।৫। ভালো মানের বাচ্চার পায়ের অনাবৃত অংশ সচ্ছ এবং চকচকে হবে।৬। ভালো বাচ্চার মৃত্যুর হার প্রায় ১% থাকে এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে যেয়ে তা ১.৫% এর বেশী হবেনা।৭। ভাল মানের বাচ্চার পা এবং ঠোট বাকা বা কোঁকড়ানো হবে না। এছাড়াও পায়ুপথ শুকনো থাকবে।সোনালি মুরগির বাসস্থানঃ
সোনালি মুরগির বাসস্থান তৈরী করতে মুরগি প্রতি .০.৮৫০ থেকে ০.৯৫০ বর্গ ফুট জায়গার প্রয়োজন হয়ে থাকে। তবে বেশি মুরগি পালনের জন্য নিচ থেকে ১ফুট থেকে ১.৫ ফুট উপরে বাশ বেধে দিতে হবে। তাহলে তুলনা মুলক বেশি মুরগি পালন করা যাবে।মুরগি পালনের আগে স্থান নির্বাচন করা সব থেকে গুরুত্ব পূর্ণ একটি বিষয় । সর্বপ্রথম উচু জায়গা নির্বাচন করতে হবে। কারণ বৃষ্টি হলে যাতে খামারে পানি জমতে না পারে । বাশ , টিন ,তার ইত্যাদি দিয়ে ভাল ভাবে বাসস্থান তৈরী করতে হবে । লোকালয় থেকে একটু দুরে তৈরী করতে হবে যাতে মুরগির রোগ কম হয়। যাতায়াত ব্যাবস্থার সুবিধা থাকতে হবে।পানি, খাবার,বিদ্যুৎ সুযোগ সুবিধা থাকতে হবে।ঘর তৈরির খরচ:একেক জন একেক ভাবে ঘর তৈরি করতে পারে। নিচে একটি আনুমানিক হিসেব দেখানো হলোঃ-
আপনার সোনালী মুরগী খামার তৈরি শেষ। এখন আপনি প্রথমে চাইছেন যে প্রায় ১০০০ সোনালি মুরগি পালন করবেন। নিচে ১০০০ সোনালী মুরগী পালনের আনুমানিক একটা হিসেব দেওয়া হলঃ
ব্রুডিং ব্যবস্থাপনা কিঃমুরগি বাচ্চা যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন তার শরীরেী তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী অংশগুলো অপূর্ণ থেকে যায়। ফলে মুরগি তার শরীরের তাপ নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। এই সময় বাচ্চা মুরগিগুলো কৃত্রিম ভাবে কিংবা প্রাকৃতিক ভাবে মা মুরগির মাধ্যমে তাপ দেওয়ার ব্যবস্থ করা হয় যা ব্রুডিং নামে পরিচিত।অন্যভাবেও বলা যায়, সদ্য জন্মানো একটি মুরগির বাচ্চাকে বাহিরের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য, ক্রমহ্রাসমান হারে যে তাপ প্রদান করা হয় তাকে ব্রুডিং পদ্ধতি বলে।ব্রুডিং এর উপকারিতাঃ
সোনালী মুরগীর খামার করে লাভ হতে হলে অবশ্যই সঠিক বাচ্চা নির্বাচন করতে হবে। তা না হলে খামার করে লাভবান হওয়া যাবে না। এর জন্য বাচ্চার ব্রুডিং তাপমাত্রা জানতে হবেঃ বয়স (সপ্তাহ)
তাপমাত্রা (সেলসিয়াস)
তাপমাত্রা (ফারেনহাইট)
১ম সপ্তাহ
৩৫ ডিগ্রি
৯৫ ডিগ্রি
২য় সপ্তাহ
৩২.২ ডিগ্রি
৯০ ডিগ্রি
৩য় সপ্তাহ
২৯.৫ ডিগ্রি
৮৫ ডিগ্রি
৪র্থ সপ্তাহ
২৭.৬ ডিগ্রি
৮০ ডিগ্রি
৫ম সপ্তাহ
২৩.৮৬ ডিগ্রি
৭৫ ডিগ্রি
লিটার ব্যাবস্থাপনাঃআরামদায়ক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেওয়ার জন্য মুরগির ঘরের মেঝেতে যে উপাদান গুলো বিছিয়ে দেওয়া হয় সেটাকে মুরগির বিছানা বা লিটার বলে। আমাদের দেশে সাধারণত ধানের তুষ লিটার হিসাবে সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে লিটার হিসেবে বালু, কাঠের ভূষি, কাঠের বাকল, আখের ছোবড়া, ধান বা গমের খড়, বাদামের খোসা, সরিষা সংগ্রহের পর গাছ ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। কাঠের ভূষি বা কাঠের গুঁড়া ব্রুডিংয়ে ব্যবহার না করাই ভাল। কারণ এতে সহজে জমাট বাঁধা ও এমোনিয়া গ্যাস তৈরি হয়ে যায়। তাই লিটার হিসাবে এমন কিছু ঠিক করতে হবে যা সহজেই আদ্রতা শোষণ করে নিতে পারে এবং সব সময় শুকনো থাকে।সোনালি মুরগির খাদ্য ও পানি ব্যবস্থাপনাঃ
সাধারণত বাজারে সোনালি মুরগির ২ ধরণের খাদ্য পাওয়া যায়।
- সোনালি স্টার্টার ফিড
- সোনালি গ্রোয়ার ফিড
খাদ্যের নাম
খাদ্য প্রদানের বয়স
সম্ভাব্য ওজন
খাদ্যের ধরণ
সোনালি স্টার্টার ফিড
১ – ৩০ দিন পর্যন্ত
৩০০-৩৬০ গ্রাম পর্যন্ত
ক্রাম্বল
সোনালি গ্রোয়ার ফিড
৩১ দিন থেকে বিক্রয় পর্যন্ত
৩১০-৩৬০ গ্রামের অধিক
পিলেট
নিদিষ্ট বয়সের মুরগির দৈহিক পুষ্টি চাহিদার উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট আকার, আকৃতি এবং পুষ্টিমানসম্পন্ন ফিড তৈরি করা হয়ে থাকে। তাই ভালো ফলাফল পেতে মুরগিকে তার বয়স অনুযায়ী নির্দিষ্ট ধরণের খাদ্য প্রদান করা উচিত।পানি ব্যবস্থাপনাঃ
সোনালী মুরগি পালন যেমন লাভজনক তেমনি বিভিন্ন রোগ সমূহ দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে রানিক্ষেত, গাম্বুরো, কক্সিডিওসিস, করাইজা, কলেরা সহ বেশ কিছু ঠান্ডা জনিত রোগ। এতে ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই। নিয়মিত টীকা বা ভ্যাকসিন প্রদান করলে এবং খামারে সঠিকভাবে জৈব নিরাপত্তা মেনে চললে এসব রোগ থেকে সহজেই মুরগিকে মুক্ত রাখা যায়।সোনালি মুরগির টিকা দেওয়ার নিয়মঃ
আগেই বলেছি সোনালী মুরগীর বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই দেখা দেয়। এর জন্য সঠিকভাবে ভ্যাসকিন প্রদান করতে হয়।নিচে সোনালি মুরগির ভ্যাকসিন দেয়ার সম্পর্কে একটি চ্যাট দেওয়া হলঃ ৩-৫ দিন
রানীক্ষেত ভ্যাকসিন
আইবি+এনডি
এক চোখে এক ফোঁটা
১০-১২ দিন
গামবোরো ভ্যাকসিন
আই বি ডি
এক চোখে এক ফোঁটা
১৮-২২ দিন
রানীক্ষেত ভ্যাকসিন
এনডি
এক চোখে এক ফোঁটা
২৪-২৬ দিন
গামবোরো ভ্যাকসিন
আই বি ডি
এক চোখে এক ফোঁটা
৪৪-৪৮ দিন
রানীক্ষেত ভ্যাকসিন (ডিমের জন্য প্রযোজ্য)
এনডি
এক চোখে এক ফোঁটা
উপসংহারঃ সোনালী মুরগীর খামার করে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। তবে এর জন্য পরিশ্রমের প্রয়োজন। বর্তমানে অনেক বেকার যুবক খামার করে বেকারত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে। তবে খামার প্রতিষ্ঠা করে লাভজনক হতে সঠিক জ্ঞান থাকতে হবে। তাই সঠিক পরিকল্পনা করে আজই নেমে পড়ুন কাজে। সফলতা আপনার কাছে ধরা দিবেই।
Bachelor of Business Administration,
East West University